• মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • কার্তিক ৬ ১৪৩১

  • || ১৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

Find us in facebook

‘আমাকে আর কেউ চাকরি দেবে না, বলবে তোর পা নেই’

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০২৪  

Find us in facebook

Find us in facebook

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)। পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় তলায় বি ওয়ার্ড। গতকাল বৃহস্পতিবার এই ওয়ার্ডে প্রবেশ করতেই দেখা গেল, একাধিক তরুণ বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা সবাই বৈমষ্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ বা অন্য কোনোভাবে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন।

তাদেরই একজন আলী আশরাফ। আন্দোলন চলাকালে বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। গুলিতে পায়ের গোড়ালি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সেই পায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোও হয়। তার বাম পায়ের গোড়ালি থেকে কেটা ফেলা হয়েছে। অন্য পা থেকে মাংস কেটে ক্ষতস্থানে লাগানোর যন্ত্রণায় তার গায়ে জ্বর চলে এসেছে। পাশে বসে ভাই রুহুল আমিন ও বোন আসমা খাতুন তার মাথায় পানি পট্টি দিচ্ছেন।

বি ওয়ার্ডের ১৪ নম্বর বেডের রোগী আলী আশরাফের অবস্থা খুব একটা ভালো না হওয়ায় তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। আশরাফ জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার আলতাফ হোসেনের সন্তান। খুলনা মণ্ডল জুট মিলে কর্মরত ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত ৫ আগস্ট দুপুরে খুলনায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি।

শুধু আলী আশরাফই নন, ওই ওয়ার্ডের ৫৬টি বেডের সব কটিতেই ছাত্র আন্দোলনে গুরুতর আহতরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। গুলিবিদ্ধ তাদের কারও পা কেটে ফেলা হয়েছে, কারও পায়ে রড লাগানো হয়েছে, কারও গুলিতে টুকরো হয়ে গেছে পায়ের হাড়।

সেখানে এমনই একজন রোগী মোহাম্মদ ইমরান হোসেন (৩২)। রাজশাহীর পুঠিয়া থানাধীন মোল্লাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সোহরাব হোসেনের সন্তান। থাকতেন রাজধানীর খামারবাড়ি এলাকার মনিপুরী পাড়ায়। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা ইমরানের আয়ে চলতো তাদের ছয়জনের সংসার।

গত ১৯ জুলাই মিরপুর-১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হন ইমরান। স্বল্প বেতনে একটি ব্যাংকে মালামাল সাপ্লাইয়ের চাকরি করতেন তিনি। ঘটনার দিন অফিস থেকে বের হয়ে কোটা আন্দোলনে গিয়েছিলেন। এরপর মিরপুর-১০ নম্বরে পুলিশ তার ডান পায়ে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ ইমরান সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন সন্ধ্যা ৭টা। এরই মধ্যে চিকিৎসা বাবদ তার এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। যার মধ্যে ঋণের টাকা ৫০ হাজার। দীর্ঘ এক মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর তার ডান পা কেটে ফেলা হয়।

ইমরান হোসেন বলেন, অফিস থেকে বের হয়ে মিরপুর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। পুলিশের একটি গুলি এসে আমার ডান পায়ে লাগে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। এখন পর্যন্ত চিকিৎসার পেছনে এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমি খুব অসহায়, বাপের জমিজমাও তেমন নেই। আমি সুস্থ হলেও সংসারটা কীভাবে চলবে সে চিন্তায় এখন দিনরাত পার করছি। সরকারের তরফ থেকে কিছু সহায়তা পেলে ছোটখাটো একটা ব্যবসা করে সংসারটা চালাতে পারতাম।

পা কেটে ফেলার আক্ষেপ ঝরে পড়ে ইমরানের কথায়। বলেন, আমাকে কেউ চাকরি দেবে না ভাই, বলবে তোর পা নেই। এটাই স্বাভাবিক। একজন সুস্থ মানুষকে রেখে আমার মতো অক্ষম মানুষকে কেন চাকরি দেবে? আমি কী করে খাবো? স্ত্রী-সন্তান ও বাবা-মাকে নিয়ে খুব বিপদে পড়েছি। পা কেটে ফেলার চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না।

বর্তমানে নিটোর তিনটি বিশেষায়িত ওয়ার্ডে যেসব রোগী ভর্তি আছেন, তারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত হয়েছেন। সেখানে সবাইকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যেসব রোগী পা হারিয়েছেন হাসপাতালের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে তাদের কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছে নিটোর।

নিটোর পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, এখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের সবার চিকিৎসা ব্যয় নিটোর বহন করছে। তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ, অপারেশন সব আমরা বিনামূল্যে দিচ্ছি। আন্দোলনে আহত রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড একটা ওয়ার্ড করা হয়েছে। যেসব রোগী হাত-পা হারিয়েছেন তাদের কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হবে। আমাদের পক্ষে যা কিছু করা দরকার, সামর্থ্য অনুযায়ী করবো। কোনো কিছুর ত্রুটি রাখছি না।

আন্দোলনে আহত তরুণদের রাষ্ট্র স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, গুলিতে যেসব তরুণ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন রাষ্ট্রই তাদের স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। এ বিষয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রস্তাব তুলে ধরবো, যেন তাদের পুনর্বাসন করা হয়। আমি মনে করি, এই আহত তরুণদের স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

Place your advertisement here
Place your advertisement here