• শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৫ ১৪৩১

  • || ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

Find us in facebook

মুমিনের জীবনে সীরাতুন্নবী (সা.) এর গুরুত্ব

দৈনিক রংপুর

প্রকাশিত: ২১ নভেম্বর ২০১৮  

Find us in facebook

Find us in facebook

ভোরে সূর্য উঠলে রাতের অন্ধকার দূরীভূত হয়ে যায়। আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে পৃথিবী। কোনো দিন এ জগৎ সূর্যের মুখ না দেখলে সবকিছু অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে প্রকৃতি, পরিবেশ।

আমরা মনে করি প্রতিটি মানবের ভেতর এমন একটি জগৎ রয়েছে। তার অবস্থাও বাহ্যিক জগতের মতো। সে জগতেরও রাত দিন আছে। আছে জীবন মরণ। বাহ্যিক এ জগত সূর্যের দেখা না পেলে যেমন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়, মানবের মনোজগৎও সূর্যের দেখা না পেলে কলুষিত হয়; ডুবে যায় অন্ধকারের অতল গহব্বরে।

সে মনোজগতকে আলোকিত করার জন্য আছে সূর্য। তবে তা দুনিয়ার সূর্যের ন্যায় উত্তপ্ত নয়। সে সূর্য হলো নবুওয়াতের সূর্য। নবুওয়াতের আলো লাভ করেছেন অসংখ্য বনী আদম। তবে তাদের কেউ কেউ লাভ করেছেন সরাসরি। আর কেউ কেউ লাভ করেছেন অন্যের মাধ্যমে। যারা সরাসরি লাভ করেছেন তাঁরা হলেন নবীগণ। আর তাদের মাধ্যমে উম্মতেরা সে আলো লাভ করেছে। নবীগণের মাঝে সর্বশেষে এসেছেন মুহাম্মাদ (সা.)। রাসূল (সা.) এর আদর্শ সর্বোত্তম, তা গ্রহণ করতে হবে:

মুমিনের মূল লক্ষ হলো আখেরাত পরকাল। তবে আখেরাতকে সুন্দর করতে হলে, সেখানে মুক্তি পেতে হলে ইহকালকে সুন্দর করে সাজাতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন, নবুওয়াতের সূর্য থেকে সরাসরি আলো প্রাপ্ত এবং এ ধারার সর্বশেষ ব্যক্তি নবী করীম (সা.) এর আলোয় জীবনকে আলোকিত করা। জীবনের প্রতিটি শাখা-প্রশাখাকে তাঁর রঙ্গে রঙ্গিন করা। এর নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে দিয়েছেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ-(অর্থাৎ) তাদের জন্য, যারা আল্লাহ ও কিয়ামত-দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে। (সূরা আহযাব, ২১) মানুষের সামনে আদর্শের বহু মডেল থাকতে পারে। তার মাঝে সর্বোত্তম হলেন, নবী করীম (সা.) এবং তিনি যে আদর্শ রেখে গেছেন।

উল্লেখিত আয়াতে, আল্লাহ তায়ালা সকলকে নির্দেশ দেননি যে, তাঁকে এবং তাঁর রেখে যাওয়া কাজকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ কর। তাকিদ দিয়েছেন তাদেরকে, যারা আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার এবং আখেরাতের সওয়াব লাভের বিশ্বাস রাখেন। কারণ, ইমান না এনে, শুধু দুনিয়ার সৌন্দর্যের জন্য তাঁকে অনুসরণ প্রকৃত অর্থে কোনো ফল বয়ে আনবে না।

সীরাত চর্চার উদ্দেশ্য হতে হবে তাঁর আদর্শের অনুসরণ:

শুধু জ্ঞান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.) সম্পর্কে জানা সফলতার জন্যে যথেষ্ঠ নয়। সফল হতে হলে, রাসূলে করীম (সা.) এর অনুসরণ, অনুকরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘(এবং) যারা সেই উম্মি ব্যক্তির অনুসরণ করে, যিনি নবী ও রাসূল, যাঁকে (অর্থাৎ যার বর্ণনা) তারা নিজেদের নিকট বিদ্যমান তাওরাত ও ইনজীলে লিপিবদ্ধ পায়- যিনি তাদের নেক কাজের নির্দেশ দেন ও মন্দ কাজ থেকে বারণ করেন এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তুরাজি হালাল করেন ও অপবিত্র বস্তুগুলো হারাম করেন এবং তাদের ওপর থেকে নামিয়ে দেন তাদের বোঝা ও শৃঙ্খল, যা তাদের ওপর ছিলো। অতএব যারা তাঁর প্রতি ইমান এনেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সেই নূরের অনুগত হয়েছে যা তাঁর সঙ্গে অবতীর্ণ করা হয়েছে-তারাই সফলকাম। (সূরা: আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৭)

উল্লেখিত আয়াতে নূর বলতে আল কোরআন উদ্দেশ্য। আয়াতের শুরু অংশে, রাসূল (সা.) সম্পর্কে পূর্ববর্তী উম্মতদের জ্ঞান থাকার বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। তবে পূর্ববতী কিতাব থেকে যারাই রাসূল (সা.) সম্পর্কে জেনেছে তারাই সফল, বিষয়টি এমন নয়। এ জন্য শেষাংশে, তাদের মাঝে কারা সফল ও সফলতার কারণ ইমান, রাসূল (সা.)-কে সাহয্য ও কোরআনের অনুগত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যদি তাঁর সম্পর্কে জানাই মুক্তি দিতো তাহলে পূর্ববর্তী উম্মতগণের মাঝে অনেকে আমাদের আগে মুক্তি পেয়ে যেতো। কারণ, রাসূল (সা.) সম্পর্কে তাদের জ্ঞান আমাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি ছিলো। আল কোরআনে তো বলা হয়েছে, তারা নিজ সন্তানের চেয়েও ভালোভাবে নবী করীম (সা.) কে চিনেতো।

কোরআনকে মেনে চলতে হলে সীরাত চর্চা করতে হবে:

উল্লেখিত আয়াতে, সফলতার জন্য কোরআনের অনুগত হয়ে চলতে বলা হয়েছে। কোরআনের অনুগত হতে হলেও নবী করীম (সা.) এর সীরাতের ওপর আমাদের আসতে হবে। তিনি যে ভাবে কোরআনকে মেনে চলেছেন সেভাবে মানতে হবে। কারণ, কোরআনের বাস্তব নমুনা ছিলেন তিনি। এ জন্য উলামায়ে কেরাম বলেন, আমাদের সামনে যে কোরআন আছে, তা হলো থিউরিকেল কোরআন। আর নবী করীম (সা.) ছিলেন বাস্তব কোরআন।

একটি হাদীস দ্বারাও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার হজরত আয়শা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, নবী করীম (সা.) এর আখলাক কেমন ছিলো? তিনি বললেন, তাঁর আখলাক হলো কোরআন। (সহীহ মুসলিম) অর্থাৎ তিনি হলেন, কোরআনের নীরব ব্যাখ্যা। তাহলে তাঁকে জানা ছাড়া কোরআনের ব্যাখ্যা বুঝা এবং সে অনুযায়ী আমল করবো কিভাবে? আরো বহু আয়াতে, নবী করীম (সা.) এর সীরাতের ওপর চলতে আদেশ করা হয়েছে। যেমন সূরা হাশরের ৭নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘রাসূল তোমাদের যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর এবং তোমাদের যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন কর।’

নবী করীম (সা.) উম্মতকে শিক্ষা-দীক্ষা বিভিন্ন পদ্ধতিতে দিয়েছেন। কখনো কাজের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন আর কখনো বা কথা ও আচরনের মাধ্যমে। এগুলোর সমষ্টিকেই বলা হয় সীরাতে নবী (সা.)। রাসূল (সা.) এর সীরাতের অনুসরণ কতটুকু দরকার তা বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হয় সূরা আল-ইমরানের দিকে। বলা হয়েছে, ‘আপনি বলুন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমার অনুসরণ কর, তা হলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (আল-ইমরান,৩১)

উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে ভালোবাসার মাপকাঠি বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ কেউ যদি প্রকৃত মালিক আল্লাহকে ভালোবাসার দাবী করে তাহলে দেখতে হবে, সে মুহাম্মাদ (সা.) এর অনুসরণের কষ্টিপাথরে টিকে কিনা। যে ব্যক্তি যে পরিমাণ আল্লাহর হাবীবের সীরাতের অনুসরণ করবে, তাঁর আনীত আলো থেকে যতটুকুকে নিজের পথের দিশা হিসেবে গ্রহণ করবে, বুঝতে হবে সে সেই পরিমাণ আল্লাহর মহব্বতের দাবিতে খাঁটি। (তাফসীরে উসমানী, উল্লেখিত আয়াত দ্র:) মুমিন জীবনে সীরাতুন্নবী (সা.) এর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন আশরাফ আলী (রাহ.)। তিনি লেখেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, নবী মুমিনদের ব্যাপারে তাদের জানের চেয়ে বেশি নিকটে।’ (সূরা –আহযাব,৬)

ইমান বলতে যা বুঝানো হয়, তা হলো মুমিনের অন্তরে নবুওয়্যাত নামক সূর্যের একটি প্রতিচ্ছায়া। নবী, ঐ সূর্য থেকে ইমানের আলো লাভ করে সরাসরি। আর মুমিনগণ লাভ করে নবীর মাধ্যমে। তাই মুমিনগণ নবীর তুলনায় ইমান থেকে দূরে। কোনো বস্তুর সরাসরি প্রতিচ্ছায়া ও ঐ বস্তুর যতটুকু কাছাকাছি থাকে, এ দুয়ের মাঝে যে পরিমাণ সুসম্পর্ক থাকে, তৃতীয়টির সঙ্গে কখনো সে পরিমাণ থাকে না। যেমন সূর্যের প্রতিচ্ছায়া দেখা গেলো আয়নায় আর তা থেকে দেখা গেলো অন্য কোথাও। তাহলে সূর্য ও আয়নার মাঝে যতটুকু সম্পর্ক, ঐ তৃতীয় বস্তু ও সূর্যের মাঝে কিন্তু ততটুকু নেই। তাই মুমিনের কর্তব্য হলো, নিজকে চেনার আগে যার মাধ্যমে সে ইমান লাভ করেছে, যাঁর সঙ্গে ইমানের কাছাকাছি সম্পর্ক তাঁকে চেনা। তাহলে তাঁর নির্দেশিত পথে চলা যাবে, অন্যকেও চালানো যাবে।

আর এর জন্য সিরাতুন্নবী (সা.) এর কোনো বিকল্প নেই। সীরাত চর্চার গুরুত্ব সম্পর্কে এই আলোচনার পর তিনি লেখেন, ‘সীরাত চর্চা দ্বারা নবী করীম (সা.) এর মর্যাদা ও তাঁর সকল দিকের যোগ্যতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হবে। তিনি সকল বিষয়ে ছিলেন, যোগ্য থেকে যোগ্যতর। তাঁর মর্যাদা ও যোগ্যতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ দ্বারা ইমানের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হবে। বৃদ্ধি পাবে ইমানী কুওয়াত। কোরআনের অনেক আয়াত ও বহু হাদীসের মর্ম বুঝে আসবে। অমুসলিমদের জন্যও সীরাত চর্চা বেকার নয়। তাদের জন্য সীরাতের জ্ঞান, ইমানের পথে আসতে সহায়ক হবে। (সিরাতে মুস্তফা, খন্ড-১, পৃষ্টা-১৩)

রাসূল (সা.)-কে স্বপ্নে দেখার উপায় সীরাত চর্চা:

সকল মুমিনের মনেই একটি আশা, একবার রাসূল (সা.)-কে স্বপ্নে দেখতে পেতাম। এর জন্য অনেকে বিভিন্ন তদবীর করে থাকে। কিন্তু নবী করীম (সা.)-কে স্বপ্নে দেখার কার্যকর তদবীর হলো সীরাতের চর্চ। প্রসিদ্ধ দায়ী কালীম সিদ্দীকি হাফিজাহুল্লাহ বলেন, অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কোন আমল করলে আমি নবী করীম (সা.)-কে স্বপ্নে দেখতে পাবো। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো, কোনো ব্যক্তি নীয়মিত প্রতিদিন সকালে যদি কোরআন তেলাওয়াত করে এবং রাতে ঘুমের আগে সীরাত অধ্যয়ন করে তাহলেই সে রাসূল (সা.) এর দিদার লাভ করবে-ইনশাআল্লাহ। এ কথাটি দাওয়াত বিষয় তিন দিন ব্যাপি এক কর্মশালায় তিনি বলেছিলেন।

রাসূল (সা.) ছিলেন, একজন আদর্শ স্বামী, পিতা। নেতেৃত্ব ও যুদ্ধের ময়দানে তিনি ছিলেন একজন আদর্শবান নেতা ও যোদ্ধা। তিনি ছিলেন, দীক্ষাগুরু। মোটকথা, রাসূল (সা.) সকল ময়দানে একটি আদর্শ ছিলেন। তাই সকল স্তরের মানুষ তাঁর সীরাত থেকে দিশা নিতে পারবে। একজন দায়ী, রাসূল (সা.) এর সীরাত থেকে দাওয়াতের পদ্ধতি ও স্তর জানতে পারবে। জেনে নিতে পারবে দাওয়াতের কোন স্তরে কোন উপকরণ ব্যবহার করতে হয়। একজন রাজনীতিক জানতে পারবে, তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে। ব্যবসায়িরা জেনে নিতে পারবে, ব্যবসার উদ্দেশ্য, ব্যবস্থাপনা ও তার তরীকা কেমন হওয়া দরকার।

মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা আমাদের রাসূল (সা.) এর সীরাত থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন যাপনের তাওফীক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন।

Place your advertisement here
Place your advertisement here