• রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৭ ১৪৩১

  • || ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

Find us in facebook

রাশিয়ায় নিজেকে প্রস্তুত করছেন পঞ্চগড়ের জোনাক!

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

Find us in facebook

Find us in facebook

দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুরের কৃতী শিক্ষার্থী শাহ জালাল জোনাক। বাংলাদেশের প্রথম মহাকাশচারী হতে নিজেকে প্রস্তুত করছেন তিনি। রাশিয়ার বাউমান মস্কো স্টেট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ‘রকেট কমপ্লেক্স অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’বিষয়ে পড়ালেখা করছেন জোনাক। রাশিয়া থেকে তিনি তার রকেট সায়েন্স নিয়ে পড়ার গল্প জানিয়েছেন ঢাকা পোস্টকে। 

জানা গেছে, তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুরে জন্ম জোনাকের। বাবা আবু বক্কর সিদ্দিক অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি শিক্ষক। মা সানজিদা শারমিন গৃহিণী। ভজনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে ভর্তি হন রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে। সেখান থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সরকারি স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান রাশিয়ায়। ভর্তি হন রাশিয়ার বাওমান মস্কো স্টেট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ‘রকেট কমপ্লেক্স অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’ বিষয়ে পড়াশোনা করছেন জোনাক।

এরই মধ্যে বাংলা ভাষায় বেশ কিছু বই লিখেছেন জোনাক। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার সাতটি বই। বইগুলো হচ্ছে ‘ম্যাজিক অফ রুবিক’স কিউব’, ‘পদার্থবিজ্ঞানের মজার প্রশ্ন ও উত্তর’, জাতির পিতাকে নিয়ে লেখা তরুণ প্রজন্মের চিঠির সংকলন ‘প্রিয় বাবা’, ‘শব্দ দিয়ে বুদ্ধির খেলা’, ‘মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি,’ ‘শব্দের গল্প’, পরিবেশ ও জলবায়ুর গল্প। 

এসব বইয়ের মধ্যে ‘মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’ বইটি প্রথম বাংলা বই হিসেবে মহাকাশে গমন করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত হয়ে আলোচিত হয়েছে। 

বই লেখা ছাড়াও তিনি বিজ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলে সেমিনার করেছেন। এ সেমিনার অনুষ্ঠানে প্রায় লাখো শিক্ষার্থীর সামনে নিজেদের ক্যারিয়ার গঠন, সুনাগরিক, আত্মনির্ভশীল হওয়াসহ দেশ গঠনে অবদান রাখতে বক্তব্য দিয়েছেন জোনাক। এসব বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়েছেন হাজারো শিক্ষার্থী। 

শাহ জালাল জোনাক বলেন, রকেট সায়েন্সে পড়াশোনাটা বেশ কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং। একটি রকেট ইঞ্জিনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়েই শুধু পড়তে হয় না, অতি কম সময়ে ইঞ্জিনের পরিবর্তনের বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়। রকেটের ইঞ্জিন এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যে অতিদ্রুত পৃথিবী থেকে মহাকাশে পাড়ি জমাবে। তা না হলে পৃথিবীর অভিকর্ষজ বলের কারণে ওপরে উঠতে পারবে না। তাই এখানে এক সেকেন্ডও অনেক বড় সময়। প্রথম স্টেজে রাশিয়ার তৈরি একটি সয়ুজ রকেট এক সেকেন্ডে প্রায় ২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ফেলে। যা চোখের পলকে প্রায় ২ কিলোমিটার। যার কারণে রকেট নিয়ে পড়াশোনাটা খুব জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং। 

পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট মানুষ মহাকাশচারীরা। কারণ মহাকাশ খুব জটিল জায়গা। অনুমান করে সব কিছু করা যায় না। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ সিদ্ধান্তের জন্য কারও ওপর নির্ভর করলেও চলে না। এ জন্য খুব বিচক্ষণ এবং স্মার্ট মানুষকগুলোকেই মহাকাশচারী হিসেবে সিলেক্ট করা হয়। এমন মানুষকে সিলেক্ট করা হয়, যারা যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো কিছু করতে পারে। ছোট্ট একটি সিদ্ধান্ত মহাকাশচারীদের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে কিংবা কেড়ে নিতে পারে।

তাই মহাকাশচারী হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে আমি নিজে থেকেই ফ্লাইট ট্রেনিং করেছি। বেসিক ইমারজেন্সি মেডিকেল ম্যানেজমেন্টের ওপর কোর্স করেছি। আত্মরক্ষার জন্য গান শুটিং শিখেছি। সামনে স্কাই ডাইভিং এবং স্কুবা ডাইভিংয়ের লাইসেন্স নেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। প্রতিটি দেশের অ্যাস্পায়ারিং অ্যাস্ট্রোনটরা নিজেদের একজন ভালো, যোগ্য মহাকাশচারী প্রার্থী হিসেবে গড়ে তোলেন। আমি সেভাবেই নিজেকে তৈরি করছি।

তিনি জানান, ২০২২ সালের মার্চ মাসে রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’ এর নিমন্ত্রণে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কাজাখস্থানে অবস্থিত রাশিয়ার বাইকোনুর কসমোড্রোম পরিদর্শন করার সুযোগ পান জোনাক। সেখানে থেকে রাশিয়ার মহাকাশচারীদের মহাকাশে পাঠানোর সকল কার্যক্রমের বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। সরাসরি মহাকাশে রকেটের উৎক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করেন। ১৮ মার্চ জোনাকের বাংলা ভাষায় লেখা বই প্রথম মহাকাশে নিয়ে যান উৎক্ষেপিত মহাকাশ মিশনের কমান্ডার রাশিয়ান মহাকাশচারী ওলেগ আর্তেমইয়েভ। বইটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করা হয়।

জোনাক বলেন, মহাকাশে বই পাঠানোর বিষয়টি মোটেও সহজ কোনো কাজ ছিল না। কারণ মহাকাশে কোনো কিছু প্রেরণ করা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। রাশিয়ান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’ বিষয়টি বিবেচনা করে অনুমতি প্রদান করে। ফলে বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম কোনো বই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করা হয়। 

তিনি বলেন, রাশিয়ায় মহাকাশ বা রকেট নিয়ে পড়াশোনার মান খুবই ভালো। তবে একটু কঠিন, সেটা হলো- এখানে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিয়ান ভাষায় পড়াশোনা করতে হয়। রাশিয়ান সরকার প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০০ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে রাশিয়াতে বিভিন্ন বিষয়ে পড়ার সুযোগ দেন। আমিও এই বৃত্তি নিয়েই রাশিয়াতে পড়তে এসেছি। ঢাকার ধানমন্ডির ‘রাশিয়ান হাউস ইন ঢাকা’ প্রতি বছর এই শিক্ষা বৃত্তির সার্কুলার দিয়ে থাকে। তাই যারা রাশিয়াতে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে আসতে চায়, তারা সেখানে আবেদন করে নির্বাচিত হলে পড়তে আসতে পারবেন।

জোনাক বলেন, রকেট নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে সবাই সচরাচর রকেট ইঞ্জিনিয়ার বা রকেট সায়েন্টিস্ট হিসেবে বিভিন্ন অ্যারোস্পেস বা স্পেস এজেন্সিতে কাজ করতে পারে, আমিও হয়তো সেটাই করতে পারব। তবে আমি চাই একজন মহাকাশচারী হতে। বাংলাদেশ থেকে এখনো কেউ মহাকাশচারী হয়নি। সেজন্য পড়ালেখার পাশাপাশি মহাকাশচারী হওয়ার জন্যও নিজেকে বিভিন্নভাবে প্রস্তুত করছি। মহাকাশচারী হওয়ার বিষয়টি যেহেতু একটি দেশের সরকারের ওপর অনেকটা নির্ভর করে, তাই এই মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে মহাকাশচারী হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি। বাংলাদেশ সরকার যখন চাইবে, প্রথম বাংলাদেশি কাউকে মহাকাশচারী হিসেবে মহাকাশে পাঠাতে, তখন যেন আমাকে পাঠাতে পারে। দিন দিন অনেক নিয়ম পরিবর্তিত হচ্ছে। কোনো মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান যদি চায়, আমাকে বাংলাদেশি হিসেবে মহাকাশে পাঠাতে, সেজন্যও আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি। এক্ষেত্রে সর্বদাই বিভিন্ন মহাকাশচারী আমাকে বিভিন্নভাবে পরামর্শ ও উপদেশ দিয়ে সাহায্য করছেন। আমি সবার প্রতি অনেক বেশি কৃতজ্ঞ। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার একটা কথাই বলার আছে, সেটি হরো- কেউ যেন তার স্বপ্ন ছেড়ে না দেয়। স্বপ্নের পথে দাঁত কামড়ে লেগে থাকলে, সফলতা আসবেই। হয়তো কিছুটা সময় লাগবে, তবে কাজ করে গেলে নিশ্চিত সফলতা আসবে। আর প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন ভিন্ন, তাই যে যেই স্বপ্ন দেখতে পারে, সে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার মতো সক্ষমতাও রাখে বলে আমি বিশ্বাস করি।

জোনাকের রাশিয়ার সহপাঠী বন্ধু চার্লসই বলেন, জোনাকের আমার প্রিয় বন্ধুগুলোর মধ্যে একজন। জোনাকের লেখা একটি বই ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছে, যা আমাদের সবার জন্যই খুব খুশির একটি খবর। এটি মহাকাশে যাওয়া বাংলা ভাষার প্রথম বই এবং আমি বিশ্বাস করি জোনাক একদিন বাংলাদেশের মহাকাশচারীও হবে। 

জোনাকের মা সানজিদা শারমিন বলেন, নিজের সন্তানের কথা বলতে কিছুটা অস্বস্তিই লাগে। ছোটবেলা থেকেই জোনাক সব সময় আউট অব দ্য বক্স চিন্তা করে। আমরা তার স্বপ্নকে সাপোর্ট দিতে চেষ্টা করেছি। তারপরও অনেক প্রতিবন্ধকতা তো ছিলই। সে তার মতো করেই চেষ্টা করে এতদূর এগিয়ে গেছে। সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। ও যেন তার স্বপ্ন জয় করে মহাকাশচারী হতে পারে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। 

ভজনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুলশিক্ষক রেবেকা সুলতানা বলেন, শাহ জালাল জোনাক আমাদের বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিল। স্কুলের পড়ালেখা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই সে অনেক বেশি অনুসন্ধিৎসু। তার জানার আগ্রহ ছিল। সে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করতে চেয়েছিল। আজ তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। রাশিয়ার মতো একটি দেশে ‘রকেট কমপ্লেক্স অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’ নিয়ে পড়ালেখা করছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। আমরা দোয়া করি সে যেন তার স্বপ্নজয় করতে পারে। দেশ ও আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করতে পারে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপঙ্কর রায় বলেন, পঞ্চগড়ের শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত মেধাবী। এমন এক মেধাবী শাহ জালাল জোনাক। আমরা তাকে জোনাক নামেই চিনি। জোনাক এই মুহূর্তে পড়াশোনা করছে রাশিয়ার বাওমান মস্কো স্টেট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ‘রকেট কমপ্লেক্স অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’ নিয়ে। সে ভবিষ্যতে মহাকাশচারী হতে চায়। ওর অনেক বড় স্বপ্ন রয়েছে। সে পঞ্চগড় ও দেশের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করতে চায়। সে চমৎকার বই লিখে। আমরা মনে করি পঞ্চগড়ে যে কয়েকটি গর্বের বিষয় রয়েছে, আমরা এখানে যে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে গর্ব করে থাকি, জোনাক তাদের মধ্যে একজন। জোনাক স্বপ্ন দেখে সে একদিন দেশের জন্য কাজ করবে। সে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষার্থী, যার লেখা বই একজন মহাকাশচারী নিয়ে গেছেন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে। এটা একটা গর্বের বিষয়। আমরা আশা করি জোনাক একদিন অনেক এগিয়ে যাবে। পঞ্চগড়ের মানুষকে গর্বিত করবে। তার দেশের প্রতি কাজ করার আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here