• বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৪ ১৪৩১

  • || ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

Find us in facebook

খেলেই পাবেন উপহার কিন্তু দুর্বলদের খেতে মানা

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৯ নভেম্বর ২০২৩  

Find us in facebook

Find us in facebook

ধরুন, আপনি দেড় কেজি চালের ভাত খেলেন। সে জন্য খাওয়া শেষে আপনাকে দেওয়া হলো এক গ্লাস দুধ, এক গ্লাস দই, একটি কোমলপানীয়। আবার আপনাকে দেওয়া হলো ৮৫০ টাকা মূল্যের প্যান্ট পিচ, যাতায়াতের ভাড়া এবং নাশতা বাবদ ১০০ টাকা বকশিশ! ধারণার বাইরের বিষয়, তাই তো? কিন্তু এভাবেই খাবার বিক্রি করে আসছেন ‘চাচার হোটেলে’র মালিক মকবুল হোসেন।

রংপুর-সুন্দরগঞ্জ মহাসড়কের পীরগাছা উপজেলার চৌধুরাণী বকসীর দিঘি বাজারে রাস্তার ধারেই ‘চাচার হোটেল’। ছোট্ট একটি টিনশেডের ঘরে মানুষের কোলাহল। সবাই খাবার খেতে ব্যস্ত। মাত্র ১৮০ টাকায় বাটিভর্তি ভাত-ডাল আর সঙ্গে ৩ পিস গরুর মাংস, অর্ধেক ডিম, সবজি, মাছ, শুঁটকি, বাদাম ও আলুভর্তা, শাক ভাজা ও সালাদসহ আরও অনেক কিছু! এখন খেতেই এত ভিড়। সঙ্গে তো চাচার হোটেলে রয়েছে পেট চুক্তিতে বিজয়ী ভোজনপ্রিয় মানুষের জন্য অন্যরকম উপহার।

একসময় পথের ধারে আটার রুটি বিক্রি করতেন মকবুল হোসেন। রুটির সঙ্গে নানা পদের ভর্তা আর চিনি দিতেন তিনি। ২০১১ সাল পর্যন্ত রুটি বিক্রির পর শুরু করেন হোটেলের ব্যবসা। অল্প সময়ে ‘চাচার হোটেল’ নামে পরিচিতি পায় মকবুলের খাবারের দোকান। খাবারে ভিন্নতা আনতে তিনি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের খাবার তৈরি করতে শুরু করেন। শুরু থেকেই হোটেলটিতে পেটচুক্তি হিসেবে খাবারের ব্যবস্থা ছিল। মকবুল হোসেনের হোটেলে এখন পাওয়া যায় ১০ রকমের ভর্তা, গরুর মাংস, হাঁসের মাংস, মুগ ডালসহ চিকন চালের ভাত। ৫০ টাকায় শুরু করে এখন ১৮০ টাকায় পেটচুক্তি খাবার মকবুল হোসেনকে এনে দিয়েছে ব্যাপক পরিচিতি।

সরেজমিনে ‘চাচার হোটেল’ গিয়ে দেখা মেলে ভোজনপ্রিয় মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সেখানে কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে আসা রাজু আহমেদ বলেন, অনেক দূর থেকে আমরা পাঁচজন একসঙ্গে এসেছি। চাচার হোটেলের অনেক সুনাম শুনেছি। ফেসবুকে ভিডিও দেখার পর আজকে এসে সরাসরি খাবারের স্বাদ নিলাম। এখানকার ১০ প্রকারের ভর্তা, গরুর মাংস ও ডালটা খুব ভালো লেগেছে। আর তিন বাটি ভাত খাওয়া সত্যি কষ্টকর। এটা আমরা কেউ পারিনি। এক বাটি ভাত পাঁচজনে মিলে খেয়েছি। সবমিলিয়ে খাবারের মান, দাম এবং পরিবেশ সবই ভালো লেগেছে।

মুক্তাদির রহমান। খাবারের অপেক্ষায় বসেছিলেন টেবিলে। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন এসেছেন। রাজশাহীর বাসিন্দা মুক্তাদিরের বর্তমান কর্মস্থল গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ। তিনি বলেন, এখানে উপহারের জন্য আসেনি বরং খাওয়াটাই আমাদের উদ্দেশ্য। আর এক বাটিতে যে পরিমাণ ভাত রয়েছে, সহজেই কেউ তিন বাটি ভাত খেতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে হোটেলর পরিবেশ এবং খাবারের দাম সন্তোষজনক।

এই হোটেলের নিয়মিত গ্রাহক তাজরুল, খোরশেদ, জুয়েল, বিপ্লব, জহুরুলসহ আরও অনেকের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, নামিদামি হোটেলের চেয়ে পেটচুক্তি খাবারে অনেক সাশ্রয়। মাত্র ১৮০ টাকায় অনেক পদের খাবার পাওয়া যায়। রান্না ও স্বাদ অতুলনীয় বলে দিন দিন এই হোটেলের গ্রাহক বাড়ছে।

কথা হয় রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ থেকে হরেক রকম ভর্তাভরা খাবার প্লেটের স্বাদ নিতে আসা মমিন ও নাকিবের সঙ্গে। সম্পর্কে তারা দুজন মামা-ভাগ্নে। খাবার খেয়ে হোটেল থেকে হয়ে হাসতে হাসতে নাকিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাঁসের মাংস আমাদের খুব প্রিয়। এজন্য এখানে খেতে এসেছি। খাবার মানসম্মত ও সুস্বাদু। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে এ খাবার অনেক সাশ্রয়ী বলে মনে করেন তিনি।

এ হোটেলে নিয়মিত খেতে আসেন পীরগাছা বাজার এলাকার মোজাহারুল ইসলাম। সঙ্গে তিনি তার নিকটজনদেরও নিয়ে আসেন। খাবার টেবিলে বসে মুখরোচক ভর্তা আর গরুর মাংসের সঙ্গে ভাত খেতে খেতে ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাচার হোটেলের খাবারের খুব স্বাদ। মানটাও ভালো। আমি তো আসি, সঙ্গে আজ আমাদের চাচাসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে এসেছি। পেটচুক্তি খাবার সাবাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এজন্য উপহারের লোভ নয় বরং ভালো খাবারের লোভেই এখানে আসা হয়।

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থেকে খেতে এসে  হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন আতিকুর রহমান। তিনি যখন হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন তখন সাড়ে তিনটা পার। ভিতরে বসার টেবিল ফাঁকা ছিল না, থেমে ছিল না ঘড়ির কাটাও। প্রায় বিশ মিনিট অপেক্ষার পর খাবারের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ না পেয়ে ফেরার পথে কথা বলেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। এরকম অনেকেই বিকেল চারটা পার হলে চাচার হোটেলে এসে আর খাবার টেবিলে বসতে পারেন না। কারণ বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে বন্ধ হয় চাচার হোটেল।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কৈকুড়ী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপাড়া গ্রামের মৃত হেলাল শেখের ছেলে মকবুল হোসেন। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও খুব একটা বাড়েনি তার খাবারের দাম। ৫০ টাকা থেকে শুরু করে প্রতিবছর ১০ টাকা করে বাড়িয়ে এখন ১৮০ টাকায় খাবার বিক্রি করছেন তিনি। নিয়ম করে সপ্তাহের ৫ দিন ভোররাত ৩টা ১০ মিনিটে দোকান খোলা হয়। বন্ধ হয় বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে। শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকে।

২৬ বছর ধরে হোটেল ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া মকবুল হোসেন জানান, হোটেল শুরুর দিকে তিনি রুটি বেচতেন। একটা রুটি খেলে দশ টাকা, দুইটা খেলেও একই টাকা। এমনি অর্ধেক খেলেও তিনি দশ টাকাই নিতেন। এভাবে বেচতে বেচতে এক কেজি করে চাল রান্না করে ১৫-২০ টাকার মধ্যে মানুষকে খাওয়াতেন। যখন বেচাবিক্রি বাড়তে থাকে, তখন তিনি ব্যবসার ধরন পাল্টে নেন। শুরু করেন ৫০ টাকায় পেটচুক্তি খাবার বিক্রি, যা বর্তমানে ১৮০ টাকা।

মকবুল হোসেন বলেন, এখন পেটচুক্তি খাবার ১৮০ টাকা। এর কম খেলেও ওই ১৮০ টাকাই দিতে হবে। তবে চাচার হোটেলে দুর্বল লোকদের খাবার খেতে মানা। চুক্তিতে খাবার খেতে সময় পাবেন ১ ঘণ্টা দশ মিনিট। কেউ যদি এক ঘণ্টা ১০ মিনিটের মধ্যে তিন বাটি ভাত (দেড় কেজি চাল) খেতে পারে তার খাবারের বিল সম্পূর্ণ ফ্রি। সঙ্গে আকর্ষণীয় উপহার হিসেবে এক গ্লাস দুধ, এক গ্লাস দই, একটা কোমলপানীয় রয়েছে। এছাড়াও পেট চুক্তিতে জিততে পারা ভোজনপ্রিয় মানুষকে প্যান্টের পিচ কেনার জন্য ৮৫০ টাকাও দেওয়া হয়।

বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়িতে দেওয়া খাবারের চেয়েও উন্নত খাবার পরিবেশনের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। এর জন্য জনপ্রতি গুনতে হবে ৩৬০ টাকা, তবে শর্ত ২০ জনের কম হলে খেতে মানা। চাচার হোটেলে ময়মনসিংহ, বগুড়া, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ এখানে খেতে আসেন- যোগ করেন মকবুল হোসেন। 

১৮০ টাকার প্যাকেজ বা পেটচুক্তি প্রসঙ্গে হোটেল কর্মচারী সাইফুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ১৮০ টাকার প্যাকেজে এক বাটি ভাত, গরুর মাংস, অর্ধেক ডিম, ভাজ মাছ, বাদাম ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, আলু ভর্তা, ধনিয়াপাতা ভর্তা, কালোজিরা ভর্তা, তিলের ভর্তা, সবজি, বুটের ডাল, টমেটো সস এবং মুখরোচক আচার। খাবার সময় এক ঘণ্টা ১০ মিনিট। কেউ যদি এক বসাতেই তিন বাটি ভাত খেতে পারে তার জন্য অনেক কিছু উপহার রয়েছে।  

ছোটবড় সবার কাছে চাচা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মকবুল হোসেন জানান, তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে হোটেলটি চালান। দিন দিন গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সাতজন কর্মচারীকে রাখা হয়েছে। প্রতিদিন ৫০-৬০ হাজার টাকার খাবার বিক্রি করেন মকবুল। প্রতিদিন কয়েক শ মানুষের রান্না হয় এই হোটেলে। এখানকার নিয়মিত গ্রাহক প্রায় ৫০ জন। অনেক যানবাহনের চালক ও শ্রমিক রাতে খাবার খান বলে রাত ৩টা ১০ মিনিটে হোটেল খোলা হয়।

মকবুল হোসেনের স্ত্রী তহিরন নেছা বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী অনেক কষ্ট করেছি। আমাদের দুটি ছেলে কয়েক বছরের ব্যবধানে মারা গেছে। আর দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। একসময়ের কষ্ট আমাদের সাফল্য এনে দিয়েছে। ভাড়ায় থাকা এই হোটেলটি আমাদের পথ দেখিয়েছে।

চাচার হোটেলের জনপ্রিয়তায় খুশি স্থানীয় কৈকুড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নুর আলম মিয়া। তিনি জানান, প্রতিদিন শুনি রংপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষজন ওই হোটেলে খেতে আসেন। এটার সুনাম তো এখন দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি নিজেও সেখানে বহুবার খেয়েছি। খাবার মান ও পরিবেশ ভালো হওয়াতে দিন দিন জনপ্রিয়তা বাড়ছে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here