• সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৮ ১৪৩১

  • || ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

Find us in facebook

নীরব ঘাতক তামাক নিঃশব্দে ধ্বংস করছে পরিবার

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১১ মার্চ ২০২৩  

Find us in facebook

Find us in facebook

গ্রামবাংলায় অনেক আগে থেকেই অতিথি এলে বাড়িয়ে দেওয়া হয় পান। তারপর টুকটুকে রাঙা ঠোঁটে পান চিবোতে চিবোতে এগিয়ে চলে আলাপ–আলোচনা। এমনকি শহরেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবারের পর পান দেওয়া হয়। পানে সুপারির সঙ্গে থাকে সাদাপাতা, জর্দা। সিগারেটের কথা তো বলাই বাহুল্য। তবে মুখে জ্বলা সিগারেট নিয়ে অনেক কড়াকড়ি আইন থাকলেও আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ সাদাপাতা, গুল, জর্দা নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। সিগারেট যে শরীরের জন্য ক্ষতিকর বিষয়টি এখন প্রায় সবার জানা। কিন্তু ধোঁয়াবিহীন তামাক যেমন গুল, সাদাপাতা, জর্দার ক্ষতিও যে মারাত্মক সে ব্যাপারে প্রচার কোথায়? তবে নীরব ঘাতক তামাক নিঃশব্দে লাখ লাখ পরিবার ধ্বংস করছে ঠিকই।

ধূমপান ও তামাক সেবনের ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতি বছরে ৮০ লক্ষাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে প্রতি বছর ১২ লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে মারা যায়। পঙ্গুত্ব বরণ করে আরো কয়েক লাখ মানুষ।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা মাওলানা বশিরুল ইসলাম। মাদরাসায় পড়াশোনার সুবাদে শিক্ষাজীবন থেকে পাতা, জর্দা, গুলসহ তামাকের রাজ্যে বিচরণ শুরু তার। ৫৫ বছর বয়সে এসে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্থূলতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত তিনি। তবুও তামাকের নেশা তিনি ছাড়তে পারছেন না। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, এক মাস আগে তিনি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। দীর্ঘ এক সপ্তাহের চিকিৎসায় তিনি আবারো সুস্থ হয়ে ওঠেন। তামাকজাত দ্রব্যের বিষয়ে চিকিৎসকের কড়া নির্দেশনায় কিছুটা কমালেও পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি তিনি।

বশিরুল ইসলামের স্ত্রী সুফিয়া আক্তার বলেন, আমাদের পরিবারে দৈনিক ৪০ টাকার পান-সুপারির প্রয়োজন হয়। সেইসঙ্গে পাতা বা জর্দাও লাগে বেশ। প্রতি মাসে পান-জর্দার পেছনে খরচ হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। শুধু এখানেই শেষ নয়, হার্টের সমস্যা আর ডায়াবেটিস থেকে স্বামীর শরীরে এখন নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। এখন প্রতি মাসে তার পেছনে সাত থেকে আট হাজার টাকার ওষুধসহ চিকিৎসাবাবদ আরো ১০ হাজারেরও বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। চিকিৎসা বন্ধ করলে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ অবস্থায় চিকিৎসার ব্যয় বহন করে সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।

‘হার্ট অ্যাটাকের পর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অতিমাত্রায় পাতা-জর্দা সেবনের কারণে আজ তার এ অবস্থা। এখন ভয়ের কারণ, যদি দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাক হয় তাহলে তাকে আর বাঁচানো যাবে না। ওনাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে কম খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে।’

এমন পরিস্থিতি শুধু বশিরুল ইসলামের নয়, সারাদেশের অসংখ্য মানুষ ও পরিবারের নিয়মিত চিত্র এটি। সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো বলছে, নীরব ঘাতক পাতা-জর্দাসহ তামাক সেবনে শুধু কিছু অর্থ নষ্ট হচ্ছে না, একজন ব্যক্তি ও একটি পরিবারকেও নিঃস্ব করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষেত্রে পানের সঙ্গে সাদা পাতা, আলা পাতা, জর্দা, মাড়িতে গুলের ব্যবহার বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের ফলে ফুসফুস ক্যান্সার, মুখ গহ্বরের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ (সিএপিডি), ডায়াবেটিস, হাঁপানি ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

তামাক নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক প্রকাশনা দি টোব্যাকো এটলাসের ২০১৮ সালের সংস্করণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ তামাকজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে। এদিকে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ, আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ও ক্যান্সার রিসার্চ-ইউকের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, সরকার সব তামাক থেকে যত রাজস্ব পায়, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হয়।

তামাকজনিত রোগে বছরে এক লাখ ৬১ হাজার মৃত্যু: 

মাদকের বিরুদ্ধে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান জিরো টলারেন্স। আর মাদকের প্রথম ধাপ হিসেবে ধূমপানকেই দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের দেওয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে মারা যান। পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরো কয়েক লাখ মানুষ। এখনো দেশের ৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করেন। ধূমপান না করেও প্রায় তিন কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিভিন্ন পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

তামাকবিরোধী সংগঠকরা বলছেন, গণপরিবহন, পার্ক, সরকারি-বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, রেস্তোরাঁ, শপিংমল, পাবলিক টয়লেটসহ বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে হরহামেশাই লোকজনকে ধূমপান করতে দেখা যায়। অথচ জনসমাগমস্থলে ধূমপান বন্ধে ২০০৫ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল একটি আইন। আইন অনুযায়ী প্রকাশ্যে ধূমপানের জরিমানা ধরা হয়েছিল ৫০ টাকা। কিন্তু পরে ২০১৩ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের সংশোধনী এনে জনসমাগমস্থলে ধূমপানের শাস্তির অর্থ ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩শ টাকা করা হয়। কিন্তু আইন না জানা ও ভাঙায় অভ্যস্ত লোকজনের অবস্থা তাতে বদলায়নি এতটুকু।

তামাকে ব্যয়িত অর্থ খাদ্য-শিক্ষায় প্রভাব ফেলে

তামাকের পেছনে অর্থব্যয় পরিবেশ, খাদ্য, শিক্ষা ও গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব ফেলে। ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের হাংরি ফর টোব্যাকো শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র অভিভাবকরা যদি তামাকের জন্য ব্যয়িত অর্থের ৬৯ শতাংশ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে, তবে দেশে অপুষ্টিজনিত শিশুমৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস্) ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী তিন কোটি ৭৮ লাখ মানুষ অর্থাৎ ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ তামাক (বিড়ি-সিগারেট, জর্দা, গুল ইত্যাদি) ব্যবহার করেন। অন্যদিকে দরিদ্র ও নিরক্ষরদের মধ্যে তামাক সেবনের হার বেশি। 

গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে ২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছরের শিশুদের মধ্যে ধূমপায়ী ২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।

শুধু সরকার নয়, বেসরকারি সংস্থা ও সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক কাজী জেবুন্নেছা বেগম বলেন, বাংলাদেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বের জনগোষ্ঠীর ৩৫.৩ শতাংশ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। ফলে বছরে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। তাই জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার ২০১৩ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ এর গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী পাস করে এবং ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০১৫ প্রণয়ন করে। আইনটির যথাযথ বাস্তবায়ন হলে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ ধূমপানজনিত অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি ও চিকিৎসা খাতের বিশাল ব্যয় হ্রাস পাবে।

তিনি বলেন, সরকার এসডিজি অর্জনকে গুরুত্ব দিয়ে সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তামাক নিয়ন্ত্রণকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তবে তামাকের ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে দেশের মানুষকে রক্ষায় শুধু সরকার নয়, বেসরকারি সংস্থা, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধিসহ সব পর্যায়ের মানুষের কার্যকর অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আমরা মনে করি, ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধানসমূহ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

জেবুন্নেছা বেগম বলেন, যারা নিয়মিত তামাক সেবন করেন তাদের তামাকের নেশা থেকে দূরে রাখতে পারলে সুস্থ জাতি ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার কাজ আরো গতিশীল হবে। এতে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশে পরিণত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

Place your advertisement here
Place your advertisement here