• রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৭ ১৪৩১

  • || ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

Find us in facebook

ভাষা আন্দোলনে নারীসমাজ

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

Find us in facebook

Find us in facebook

              
ভাষা আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা, বিশেষ করে ছাত্রীরাও রাজপথে নেমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এর আগে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে এ রকম ব্যাপক হারে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ দৃষ্টিগোচর হয়নি। এ দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে এটি ছিল নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার সামাজিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তত্কালীন রক্ষণশীল সামাজিক পটভূমিতে ভাষা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ ছিল একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর লেখনী প্রচেষ্টার মাধ্যমে শুরু হয় নারীর আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ। তত্কালীন সময়ে নারীদের মুখপত্র বেগম পত্রিকা বিভিন্ন প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, সম্পাদকীয় প্রভৃতির মাধ্যমে ভাষার প্রশ্নে তাদের মনোভাব ফুটিয়ে তোলে। মোহেসনা ইসলাম, বেগম আফসারুন্নেসা, নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের মহিলা সংগঠনের সম্পাদিকা মিসেস রুকিয়া আনোয়ার প্রমুখের লেখায় এ সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।

দেশ বিভাগোত্তর পরিস্থিতিতে বিশিষ্টজনেরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে স্মারকলিপি প্রদান করেন, স্বাক্ষর প্রদানকারী নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আনোয়ারা খাতুন, লিলি খান, লীলা রায়, রুকিয়া আনোয়ার প্রমুখ। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সফল করার ক্ষেত্রে বেগজাদী মাহমুদা নাসির, মমতাজ বেগম, মালেকা, সুলতানা রাজিয়া আফরোজা, খালেদা খানম প্রমুখের অবদান অনস্বীকার্য।  ভাষা আন্দোলনের তত্পরতা ছড়িয়ে দেওয়ার নাদিরা বেগম ও শাফিয়া খাতুন অন্যতম ভূমিকা রাখেন। আন্দোলনে লায়লা সামাদ, শামসুন নাহার, শাফিয়া খাতুন, সারা তৈফুর, রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া ইব্রাহিম, রওশন আরা রহমান, হালিমা খাতুন, কায়সার সিদ্দিকী প্রমুখ ছাত্রীর অংশগ্রহণমূলক অবদান ছিল চোখে পড়াম মতো।

বলে রাখা দরকার, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ছাত্রদের দু-তিনটি দল বের হয়ে যাওয়ার পরপরই সুফিয়া ইব্রাহিম, শাফিয়া খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন্নাহার, সারা তৈফুর প্রমুখ ছাত্রী কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বের হন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের পর নারীরা বিভিন্ন স্থানে সভা করে এর প্রতিবাদ জানান। ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আজিমপুর কলোনির মেয়েরা একটি প্রতিবাদ সভা করেন এবং কমলাপুর ও অন্যান্য দূর এলাকা থেকে এসে মেয়েরা তাতে যোগদান করেন। কয়েক হাজার নারী এই সভায় একত্রিত হয়ে সরকারের বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ১২ নম্বর অভয় দাস লেনে ছাত্র ও জনসাধারণের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে নারীদের এক বৃহত্ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবের অন্যতম ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা অমান্য করার জন্য গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তিদান।

আন্দোলন-সংগ্রামের প্রয়োজনে নারীরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক মোসলেমা খাতুন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রী) বলেন, ‘শুনলাম, আন্দোলনের নেতারা বলেছেন আন্দোলন পরিচালনার জন্য, আহতদের চিকিত্সার জন্য টাকার দরকার। রাতে সিনিয়র-জুনিয়র সব ছাত্রী একসঙ্গে বসে আলোচনা করে ঠিক করা হলো ভোরে উঠে আমরা দুজন দুজন করে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ব আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলব। ২২ ফেব্রুয়ারিও গোটা শহর ছিল উত্তেজনাপূর্ণ, বিক্ষুব্ধ। আমি আর সুফিয়া খাতুন বের হলাম একসঙ্গে। আমরা গেলাম শান্তিনগর ও মালিবাগ এলাকায়। সারা দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুললাম। যে বাড়িতেই গিয়েছি, সেখানেই পেয়েছি ছাত্রদের জন্য সহানুভূতি।’ ছাত্রীরা শুধু ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় নয়, তাদের আ্তীীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকেও চাঁদা তুলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ বলেন, ‘এর পরদিন (২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) আর বের হইনি। তবে হোস্টেলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। খুরশেদী আলম (ডলি) আপার সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। তিনি এসে আমাদের বললেন, দেখ কিছু টাকাপয়সা ওঠাতে পার কি না। তখন আমরা বকশীবাজারে থাকতাম। সাফিয়া আপা, লায়লা সামাদ আপা, খুরশেদী আপাসহ আমরা বের হতাম। উয়ারি এলাকায়ও আমরা সম্ভবত গিয়েছিলাম। খুবই সাড়া পেয়েছি।’

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনেসকো বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালি জাতির এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এভাবেই বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা ইউনেসকো কর্তৃক স্বীকৃতি লাভের মধ্য দিয়ে বিশ্বভাষার রূপ পরিগ্রহ করে। পৃথিবীর কোথাও ভাষার নামে কোনো দেশ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছে ভাষার নামে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা একই সঙ্গে ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে।

লেখক, শিক্ষক: ড. মো. মোরশেদুল আলম , চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Place your advertisement here
Place your advertisement here