• শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৬ ১৪৩১

  • || ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

Find us in facebook

অসম প্রেম: গাছে চিঠি সাঁটিয়ে তুলে নেয়ার ঘোষণা, অতঃপর ‘অপহরণ’

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪  

Find us in facebook

Find us in facebook

হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিশোরীর সঙ্গে মুসলিম যুবকের অসম প্রেম। সেই প্রেমের সম্পর্কের জেরে যুবক কর্তৃক কিশোরীকে তুলে নিয়ে বিয়ে করার ঘোষণা এবং শেষ পর্যন্ত ভাগিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী কিশোরীর বাবা বাদী হয়ে অভিযুক্ত যুবক, তার ভাই ও বোনের বিরুদ্ধে ‘অপহরণের’ অভিযোগ এনে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ফুলবাড়ী থানায় মামলা করেছেন।অভিযুক্ত যুবকের নাম আলিনুর রহমান (৩৫)। তিনি কাশিপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ অন্তপুর গ্রামের আব্দুল হালিমের ছেলে। ভুক্তভোগী কিশোরী একই গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফুলবাড়ী থানার ওসি নওয়াবুর রহমান।

মামলার এজাহারে কিশোরীর বাবা উল্লেখ করেন, আসামি আলিনুর তার দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে স্কুল যাওয়ার পথে প্রেমের প্রস্তাব দিত। তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখানোসহ নানাভাবে উত্তক্ত করত। কিশোরী এ বিষয়টি পরিবারকে জানালে স্থানীয়ভাবে সালিশ করে অভিযুক্ত আলীনুরকে সতর্ক করা হয়। তাকে এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। এ নিয়ে আলিনুর ও তার পরিবারের লোকজন কিশোরীর পরিবারের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। সম্প্রতি আসামিরা ওই কিশোরীকে তুলে নিয়ে গিয়ে মুসলিম করার ঘোষণা সংবলিত একটি কাগজ বাড়ির সামনের জাম গাছে সাঁটিয়ে দেয়। এ পরিস্থিতিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে আলিনুরসহ অন্য আসামিদের সহায়তায় ওই কিশোরীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তুলে নেয়া হয়। পরবর্তীতে বুধবার রাতে আসামি আলিনুরের বাড়িতে গিয়ে মেয়ের খোঁজ করে তাকে ফেরত চাইলে পরিবারের লোকজন কিশোরীর বাবাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।

ঘটনার অনুসন্ধানে যা জানা গেল:

এদিকে কিশোরী ‘অপহরণ’ হওয়ার খবরে নড়েচড়ে বসে থানা পুলিশ। ঘটনার অনুসন্ধানে নামে স্থানীয় সংবাদকর্মীসহ হিন্দু ধর্মীয় নেতারা। উভয় পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলিনুরের বাড়ি থেকে কিশোরীর বাড়ির দূরত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার। আলিনুরের বাড়ির পাশের পথ ধরেই প্রতিদিন স্কুলে যায় ওই কিশোরী। এই সুযোগে আলিনুর তাকে ফুসলিয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। বয়স ও ধর্মের বিবেচনায় অসম এই প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ হলে কিশোরীর পরিবারের অনুরোধে সালিশ বৈঠক হয়। দেড় মাস আগে হওয়া সেই সালিশে আলিনুরকে সতর্ক করে দেন স্থানীয় মাতবররা। কিছুদিন সংযত থাকে আলিনুর।

সালিশের কয়েকদিনের মধ্যে আলিনুরকে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয়। মাস ঘুরতে না ঘুরতে সেই সংসার ভেঙে যায়। পরিবার সতর্ক থাকায় আলিনুর ও ঐ কিশোরী কৌশলে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। যদিও আলিনুরের পরিবারের দাবি, কিশোরীর অব্যাহত চাপে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন আলিনুর।

আলিনুরের মা আনোয়ারা বলেন, ‘প্রেমের সম্পর্ক প্রকাশ হলে সালিশ হয়। আলীনুরকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তাকে পেটানো হয়। এরপর তাকে আমরা বিয়ে দেই। কিন্তু ওই হিন্দু মেয়ে আমার ছেলেকে তালাকের জন্য চাপ দিতে তাকে। বউ না ছাড়লে ছেলের ঘরে এসে গলায় ফাঁস দেওয়ার হুমকি দেয়। ছেলে বউ ছাড়ে। এরপর এ ঘটনা ঘটলো।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুস ছালেক বলেন, ‘দেড় মাস আগে সালিশ করে ছেলেকে শাসন করা হয়েছিল। এরপর বুধবার বিকেলে মেয়েকে নিয়ে চলে যায়।’

স্থানীয়রা যা বলছেন:

আলিনুরের সঙ্গে কিশোরীর প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি স্থানীয়দেরও জানা। তবে বয়সের দূরত্ব ও ধর্মীয় পার্থক্যের কারণে তাতে কারও সমর্থন ছিল না।

ওই গ্রামের বাসিন্দা পুষ্পবালা (৬০) বলেন, ‘উভয়ের মধ্যে একটি বোঝাপড়া ছিল। না থাকলে দুজনে চলে যাইতে পারে না।’

কিশোরীর প্রতিবেশী উত্তম রায় বলেন, ‘মেয়ের ইচ্ছাতেই ছেলে তাকে নিয়ে গেছে।’

গ্রাম পুলিশ অনিল চন্দ্র বলেন, ‘দেড় মাস আগে মেয়ের কাছে ছেলের দেওয়া ফোন উদ্ধার হলে প্রেমের সম্পর্ক প্রকাশ হয়। এরপর প্রায় এক দেড়শ’ লোকের উপস্থিতিতে সালিশ হয়। তখন থেকে তাদের প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি সবার জানা। মেয়েটাও ওই ছেলের জন্য পাগলামি করছিল। ’

কিশোরীকে তুলে নিয়ে মুসলিম করার ঘোষণা:

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে কিশোরীর বাড়ির সামনে একটি জাম গাছে কাগজে লেখা একটি ঘোষণাপত্র সাঁটানো দেখতে পান স্থানীয়রা। তাতে লেখা ছিল ‘৭ দিনের মধ্যে এই বাড়ির মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, মেয়েকে মুসলমান করা হবে’। এ ঘটনায় আতঙ্ক প্রকাশ করে স্থানীয় বাসিন্দা রজিত চন্দ্র অজ্ঞাত ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন। তবে ওই জিডি নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পুলিশ। ভুক্তভোগী কিশোরীসহ স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবি, পুলিশ ওই জিডির বিষয় তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

ভুক্তভোগী কিশোরীর বাবা বলেন, ‘গাছে হুমকির চিঠি দেখে আমরা আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম। হুমকিদাতা তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলো। মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে। মামলা করেছি। আমার মেয়েকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত চাই।’

এফিডেভিট করে ধর্মান্তরিত হয়েছেন কিশোরী:

গত ১২ সেপ্টেম্বর নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট করে ওই কিশোরী ধর্মান্তরিত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এফিডেভিটটির একটি কপি প্রতিবেদকের কাছে এসেছে। তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে নতুন নাম রেখেছেন সাজেদা খাতুন। এফিডেভিটে স্বাক্ষরকারী কুড়িগ্রামের আইনজীবী সোহেল রানা বাবুর সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ফুলবাড়ী উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অনীল চন্দ্র রায় বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে স্থানীয়দের কাছে ওই যুবকের সঙ্গে কিশোরীর প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি জানাতে পারি। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে সালিশও হয়েছিল। তবে মেয়ের পরিবার প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। পরিবারের নিষেধ থাকার পরও অপ্রাপ্তবয়স্ক স্কুল ছাত্রীকে এভাবে নিয়ে যাওয়া আইনসম্মত হয়নি। আমি আইনি বিহিত দাবি করছি।’

ওসি নওয়াবুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে উভয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের সত্যতা পাওয়া গেছে। মেয়ের বাবার এজাহারের ভিত্তিতে মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে। গত রাতে অভিযান চালিয়ে আসামিকে গ্রেফতার ও কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়েছে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here